এসআরভি স্টেশন এখন রীতিমত ট্রাক টার্মিনাল

রেল কর্তাদের চিঠি চালাচালি,স্টেশন দখল করে চাঁদাবাজি ২ পরিবহন নেতার

Passenger Voice    |    ০৪:০৫ পিএম, ২০২০-১১-১৩


রেল কর্তাদের চিঠি চালাচালি,স্টেশন দখল করে চাঁদাবাজি ২ পরিবহন নেতার

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম নগরীর স্ট্যান্ড রোড ভিক্টোরিয়া (এসআরভি) রেল স্টেশনের চারপাশ ঘিরে দুই পরিবহন নেতার প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ। তবে এই চাঁদার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত রেলের কর্মকর্তারা। তবে সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রশ্নের জবাব দিতে কর্মকর্তারা একে অপরের কাছে চিঠি চালাচালি করে ডকেট ভুক্ত করে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান ও সাংবাদিকের সরেজমিন প্রতিবেদন কালে এক কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তার কাঁধে দোষ চাপাতে ব্যস্ত থাকেন। 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তিন দফতরের শীর্ষ কর্তারা অবৈধ দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন চট্টগ্রামের এসআরভি স্টেশনের ইয়ার্ড এবং এর ৩ নম্বর লাইনের পাশে রেলের জমিতে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের অবৈধ পার্কিং করে দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে বেসরকারি পরিবহন সংস্থার লোকজন। এছাড়া স্টেশনের অভিমুখ সড়কের দুই পাশে প্রচুর পরিমানের অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।

রেলের সূত্র ধরে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের প্রতিবেদক সরেজমিন স্টেশনটিতে যায়। পরিচয় গোপন করে কথা হয় স্টেশনে গড়ে উঠা দুই গ্যারেজ মালিকের সঙ্গে। এই আলাপকালে উঠে আসে এসআরভি স্টেশন কেন্দ্রিক রেল কর্মকর্তা ও পরিবহন নেতাদের মাসে লাখ টাকার চাঁদাবাজির চাঞ্চল্যকর তথ্য। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্টেশনে রেল লাইন ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি গ্যারেজ যার একটির মালিক পরিবহন নেতা অরুন বাবু অপরটির অনিল বাবু। এই গ্যারেজগুলোতে ৫শ এর বেশি ট্রাক কাভার্ড ভ্যান পার্কিং এবং মেরামত করার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। এখানে গাড়ি রাখতে হলে মান্থলি বা মাসিক চুক্তি করতে হয়। শুধু পার্কিং এর জন্য মাসে দিতে হয় ১৫০০ টাকা করে আর পার্কিং এর সাথে গাড়ির মেরামতের কাজ করানোর চুক্তি হলে মালিকদের গুণতে হয় গাড়ি প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে। আবার মান্থলি না করে একদিনের জন্য গাড়ি রাখতে দিতে হবে ২০০ টাকার চাঁদা। ৫০০ ট্রাকের জন্য গাড়ি প্রতি ২ হাজার টাকা করে মাসে ১০ লাখ টাকা, বছরে এক কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয় অঘোষিত এই ট্রাক টার্মিনালে। কোটি টাকার চাঁদাবাজির সিংহভাগই চলে যায় রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পকেটে। তাই স্টেশন আঙিনায় এমন অবৈধ পার্কিং করলেও কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না ট্রাক মালিকদের। এমনটাই জানিয়েছেন গ্যারেজ মালিক অরুন ও অনিল। আরও  জানা যায়, ট্রেন আসার আগে স্টেশন মাস্টার এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকেই এই খবরটি সংশ্লিষ্ট ট্রাক চালকদের কাছে পৌঁছে দেয়। ফলে তারা সুবিধাজনক ভাবেই গাড়িগুলো সরিয়ে নিয়ে থাকে। 

সূত্র বলছে, ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনের ১২ নম্বর ধারা মোতাবেক রেললাইনের দুপাশে ১০ ফুট করে এলাকার মধ্যে রেলের কর্মী ছাড়া অন্যকারো প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই এলাকায় সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে। এমনকি এর মধ্যে গরু-ছাগল ঢুকে পড়লে সেটিকেও নিলামে বিক্রি করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে আইনের ১০১ ধারায় যে কাউকে গ্রেফতার করা যায়। এমন কোঠর আইন থাকার পরও এসআরভি স্টেশনে রেল লাইনের উপরেই ট্রাক, কাভার্ডভ্যান রাখা হলেও এর বিরুদ্ধে কোন স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের। গত বছর রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ এই স্টেশনের আশপাশে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তার আচর পরেনি স্টেশন আঙিনায় থাকা এই ট্রাক টার্মিনালের দিক। এদিকে অবৈধ স্থাপনা কিছু উচ্ছেদ হলেও প্রকৌশল বিভাগ ও স্টেশন মাস্টারদের অবহেলায় তা পুনরায় দখল হয়ে গেছে।

জানা যায়, বর্তমানে এই স্টেশনে একজন করে ইনচার্জ মাস্টার,পয়েন্টস ম্যান ও গার্ড আছে। এছাড়া রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন হাবিলদার ও ৬ সদস্য রয়েছে। স্টেশন দখল করে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে তাদের প্রশ্ন করা হলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কে চিঠি দিয়েছি বলে দায় সেরে নেয়। অথচ স্টেশন মাস্টারদের জিএস রুল এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আইন বলে অবৈধ দখলের দায়ভার তারা এড়াতে পারেনা। এদিকে পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন চিঠি অগ্রবর্তী করে উচ্ছেদের জন্য ভূ-সম্পত্তি বিভাগে দিয়েছি।  

এ বিষয়ে রেলওয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবুল করিম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, রেলের জায়গা দখল করে চাঁদাবাজি করার সুযোগ নেই। আমি যোগদান দেয়ার পর থেকে বহু ভূমি উদ্ধার করে রেলের নিয়ন্ত্রনে নিতে সফল হয়েছি। এসআরভি স্টেশনটি বন্দর কেন্দ্রিক হওয়ায় এটি চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্টেশন। আমি গুরুত্বের সাথে বিষয়টি দেখবো এবং পর্যায়ক্রমে স্টেশনটির আশ পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবো।  

এ বিষয়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) চীফ কমান্ডেন্ট (পূর্ব) জহিরুল ইসলাম কে গতকাল এবং আজকে একাধিকবার ফোন করেও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা রেলওয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) নওরোজ হাসান তালুকদার প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি বিষয়টি খবর নিয়ে দেখবো। যদি এটি রেল পুলিশের এখতিয়ারভূক্ত এলাকায় পরে তাহলে দ্রুতই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিবো। 

উল্লেখ্য, এসআরভি স্টেশনটি রেলওয়ের পুরনো স্টেশনগুলোর অন্যতম। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এ স্টেশনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চলত। আমদানিকৃত পাথর,খাদ্যপণ্য,সার,ভারী মূলধনি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বন্দর থেকে খালাসের পর এসআরভি স্টেশনে বোঝাই হয়ে গন্তব্যে পৌঁছে। রেল অবকাঠামো নির্মাণের ভারী কাঁচামালও এ স্টেশনেই লোডিং-আনলোডিং হতো। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছের স্টেশন হওয়ায় আমদানিকারকরাও এসআরভি স্টেশনে মালপত্র বোঝাইয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। বর্তমানে এটি অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে তবে স্টেশনটি সচল থাকলে পণ্যের পরিমাণ ও সরকারের রাজস্ব আয় আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হত।

আরও পড়ুন >>>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

আরও পড়ুন >>>>> রেলের অবৈধ বস্তিতে বিদ্যুৎ-পানি চুরির মহোৎসব,দেশের রাজস্ব ক্ষতি ১০ কোটি টাকা

আরও পড়ুন >>>>>> রেলের জায়গা অবৈধ ভাবে দখলের চেষ্টা চট্টগ্রাম ওয়াসার